"সন্দ্বীপ"
পার্বত্য অঞ্চল চট্টগ্রামের একটি ছোট্ট উপজেলা। বঙ্গোপসাগর আর মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত এই দ্বীপটি
যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি রয়েছে অবাক করার মতো কিছু ইতিহাস।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপকূল থেকে নদীপথে ১০ মাইল দূরে সন্দ্বীপের অবস্থান। উত্তরে বামনী নদী, পশ্চীমে মেঘনা নদী,
এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে গড়ে উঠেছে এই দ্বীপটি।
বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চল থেকে সন্দ্বীপ উপজেলায় যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে সন্দ্বীপের আয়তন প্রায় ৬৩০ বর্গমাইলের হলেও ক্রমাগত নদী ভাঙনের কারণে, বর্তমানে এটি মাত্র ৮০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। সন্দ্বীপের বর্তমান দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৫ কিলোমিটার।
সন্দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়।
কারও কারও মতে বার আউলিয়ারা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এই দ্বীপটি জনমানুষহীন অবস্থায় আবিস্কার করেন, এবং নামকরণ করেন 'শুণ্যদ্বীপ', যা পরবর্তীতে 'সন্দ্বীপে' রুপ নেয়।
কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে 'স্বর্ণদ্বীপ' আখ্যা প্রদান করেন। উক্ত 'স্বর্ণদ্বীপ' হতে 'সন্দ্বীপ' নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
দ্বীপের নামকরণের আরেকটি মত হচ্ছে পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিগণ বাংলাদেশে আগমনের সময় দূর থেকে দেখে এই দ্বীপকে বালির স্তুপ বা তাদের ভাষায় 'স্যান্ড-হীপ' নামে অভিহিত করেন, এবং তা থেকে বর্তমান 'সন্দ্বীপ' নামের উৎপত্তি হয়।
ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাসে জানা যায় যে সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছরের অধিককাল ধরে লোক বসতি বিদ্যমান। সন্দ্বীপের লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্র শিল্প পৃথিবী খ্যাত ছিল। উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করতেন, এবং সহজ বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং পরিবহন সুবিধাদি থাকায়
এই অঞ্চলে ব্যবসা এবং বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন।
১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছর সন্দ্বীপে উৎপাদিত প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত।
ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর।
১৬১৫ সালে পর্তুগিজদের সাথে আরকান রাজ্যের যুদ্ধে ২০০ জন সৈন্যসহ পর্তুগীজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত হয়,
এবং পর্তুগিজরা সন্দ্বীপ ত্যাগ করলে ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখল করে।
এরপর সন্দ্বীপে আরকান ও মগদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের পরাধীনতাকে অস্বীকার করে একে প্রায়
অর্ধ শতাব্দী শাসন করেন দেলোয়ার খাঁ। এবং বর্তমান সন্দ্বীপের প্রধান সড়কের নাম করণ করা হয়েছিলো এই দেলোয়ার খাঁ এর নামেই।
১৬৬৬ সালে তার রাজত্বের পতন ঘটে এবং মোগল সরকারের অধীনে জমিদারী প্রথার সূচনা ঘটে,
যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়।
রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে।
১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপে আসেন।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী মোজাফ্ফর আহমেদের সাথে সন্দ্বীপে আসেন
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
সন্দ্বীপ ভ্রমণের সময়কার স্মৃতির পটভূমিকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম তার মধুবালা গীতিনাট্য রচনা করেন।
সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তার চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এখান থেকে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন।
১৯৭১ সালে এ উপজেলা ১নং সেক্টরের অধীন ছিল।
১৯৫০ হতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সন্দ্বীপের ভাঙ্গন অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল।
তবে অধিক নদী ভাঙনের ফলে ১৯ ইউনিয়নের এই থানা বর্তমানে উড়িরচর বাদে ১৩ ইউনিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বর্তমানে এই দ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় চার লাখ।
সন্দ্বীপ উপজেলার সাক্ষরতার হার ৫১.৫০%।
সন্দ্বীপের বর্তমান অর্থনীতি প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থান হতে পাঠানো প্রবাসী রেমিটেন্স।
এছাড়াও কৃষি, মৎস্য চাষ এবং ধান থেকে আসে।
শত শত বছর ধরে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সন্দ্বীপে আঘাত হেনেছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে এসকল ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়।
স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম ঘূর্ণিঝড়টি ২৯শে এপ্রিল ১৯৯১ সালে সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।
এই ঘূর্ণিঝড়ে সন্দ্বীপের উপকূলীয় অঞ্চলের কমপক্ষে ৬০ হাজার এবং ঝড়ের পরে অনাহারে ও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগে
আরো প্রায় ২০-৩০ হাজার লোক প্রাণ হারায়।
মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা কবি বেলাল মোহাম্মদ, ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী
স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব লালমোহন সেনের জন্ম এই সন্দ্বীপেই। এবং এই সন্দ্বীপের আরো অনেক ব্যাক্তি বর্গ রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত
অবদান রাখছেন বাংলাদেশের উপরস্থ অনেক পর্যায়ে।
১৯৭৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যারা রাজনৈতিক ভাবে সন্দ্বীপ শাসন করেন, তাদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলেন,
আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল পাশা এবং বর্তমান সংসদ সদস্য মাহফিজুর রহমান মিতা।
২০১৮ সালে এই সন্দ্বীপ ১৫ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে জাতীয় গ্রীডের বিদ্যুতের সাথে সংযুক্ত হয়।
সবুজে শ্যামলে ঘেরা এই সন্দ্বীপ হাজার বছর পরেও অটুট রেখেছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ অঞ্চলের মানুষের আচার ব্যাবহার এবং
অতিথি পরায়ণতা যে কাউকেই মুগ্ধ করার মতো। ধনি গরীব নির্বিশেষে এই অঞ্চলটি খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে টিকেয়ে রেখেছে তাদের জীবন যাত্রার মান।
উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো এই অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করে যাবে আপনার আমার মতো আরো অনেক মানুষকে।
#Sandwip #সন্দ্বীপ #History_of_Sandwip #Sandwip_Documentary
ISLAND TOUR - SANDWIP - CHITTAGONG - BANGLADESH
Ещё видео!